হার্ট অ্যাটাককে আমরা সাধারণত ‘হঠাৎ ঘটে যাওয়া’ এক প্রাণঘাতী ঘটনা ভেবে থাকি। কিন্তু বাস্তবে তা একেবারেই হঠাৎ নয়। এর আগে শরীর নীরবে পাঠাতে থাকে একের পর এক সতর্ক সংকেত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই আগাম বার্তাগুলোকে বলা হয় ‘প্রোড্রোমাল সিম্পটম’ বা প্রাথমিক উপসর্গ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বেশিরভাগ মানুষ এগুলোকে সাধারণ অসুস্থতা ভেবে অবহেলা করেন। অথচ সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, হার্ট অ্যাটাক হওয়ার অন্তত এক মাস আগেই শরীরে কিছু উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। যেমন—মাঝে মাঝে বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, হালকা মাথা ঘোরা কিংবা অকারণে ক্লান্তি। এগুলো আগেভাগে চিনে ফেলতে পারলে বিপদ এড়ানো যায় সহজেই।
হার্ট অ্যাটাকের আগাম ১২টি সতর্ক সংকেত
১. বুকে ব্যথা
প্রায় ৬৮ শতাংশ রোগী হার্ট অ্যাটাকের আগে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। এই ব্যথা আসে-যায়, কখনও বাড়ে আবার কমে। শারীরিক পরিশ্রম বা মানসিক চাপে তা আরও তীব্র হতে পারে। অনেক সময় এটি অ্যাসিডিটি ভেবে ভুল করা হয়, যা হতে পারে প্রাণঘাতী।
২. বুক ভারী লাগা বা চাপ অনুভব করা
চলাফেরা বা সামান্য পরিশ্রমেই যদি বুক ভারী লাগে বা চেপে ধরা অনুভব হয়, সেটি বিপদের ইঙ্গিত। প্রায় ৪৪ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই এটি ছিল আসন্ন হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ।
৩. অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
হঠাৎ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, দ্রুত বা অনিয়মিতভাবে ধুকপুক করা—হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচলের সমস্যা নির্দেশ করে। প্রায় ৪২ শতাংশ রোগীর এমন উপসর্গ দেখা গেছে।
৪. শ্বাসকষ্ট
স্বাভাবিক কাজেও যদি দম নিতে কষ্ট হয় বা মনে হয় অক্সিজেন ঠিকমতো পাচ্ছেন না, এটি হৃদরোগের প্রাথমিক সতর্কতা হতে পারে।
৫. বুক জ্বালাপোড়া বা অম্বল
অনেকে এটি সাধারণ অ্যাসিডিটির সমস্যা ভেবে ভুল করেন। কিন্তু বারবার বুক জ্বলা হার্টের ধমনিতে ব্লকেজের লক্ষণ হতে পারে।
৬. অকারণে ক্লান্তি
পর্যাপ্ত ঘুমের পরও সারাদিন অবসন্ন লাগা হার্টে রক্তপ্রবাহের সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষত নারীদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
৭. মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারানো
হঠাৎ মাথা ঘোরা বা অস্থিরতা শরীরে রক্ত প্রবাহে জটিলতা নির্দেশ করতে পারে।
৮. বমি বমি ভাব বা পেটের অস্বস্তি
গ্যাস্ট্রিক বা হজমজনিত সমস্যা ভেবে অনেকেই এড়িয়ে যান। কিন্তু বারবার বমি বমি লাগা বা পেটের অস্বস্তি হার্টের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।
৯. অজানা উদ্বেগ বা আতঙ্ক
কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই উদ্বেগ বা আতঙ্কের অনুভূতি দেখা দিলে তা মানসিক চাপ নয়, বরং হৃদরোগের আগাম বার্তাও হতে পারে।
১০. ঘুমের সমস্যা
রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, শ্বাসকষ্টে জেগে ওঠা বা শোয়ার সময় দম বন্ধ হয়ে আসা—এগুলিও হৃদরোগের সংকেত।
১১. পা বা গোড়ালি ফুলে যাওয়া
হৃদপিণ্ড ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে না পারলে শরীরে তরল জমে যায়, যার প্রভাব পড়ে পা, গোড়ালি ও পায়ের পাতায়।
১২. শরীরের অন্য অংশে ব্যথা
হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা শুধু বুকে সীমাবদ্ধ থাকে না। হাত, পিঠ, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা দেখা দিতে পারে—যা কয়েক দিন আগেই অনুভূত হয়।
নারী ও পুরুষের উপসর্গে পার্থক্য
চিকিৎসকরা বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ অনেক সময় ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। অতিরিক্ত ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, হজমে সমস্যা বা চোয়াল ও পিঠে ব্যথা—এসবকেই অনেকে সাধারণ অসুস্থতা ভেবে অবহেলা করেন, ফলে চিকিৎসা নিতে দেরি হয়।
কেন আগেভাগে সংকেত দেয় শরীর
হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ হলো হৃদপিণ্ডে রক্তপ্রবাহে বাধা। ধমনিতে চর্বি, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পদার্থ জমে ‘প্লাক’ তৈরি করে। যখন এই প্লাক ফেটে যায়, রক্ত জমাট বেঁধে ধমনী বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটায়, যেগুলো উপসর্গ হিসেবে প্রকাশ পায়।
শেষ মুহূর্তের তীব্র সতর্কতা
হার্ট অ্যাটাকের ঠিক আগে শরীর আরও শক্তিশালী সংকেত পাঠায়—তীব্র বুক ব্যথা, অতিরিক্ত ঘাম, বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট কিংবা পিঠ ও চোয়ালে ব্যথা। এসব একসঙ্গে দেখা দিলে চিকিৎসা নিতে দেরি করা বিপজ্জনক।
হার্ট অ্যাটাক সবসময় হঠাৎ ঘটে না। শরীর এক মাস আগেই সেই বিপদের বার্তা পাঠাতে শুরু করে। তাই নিয়মিত বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘুমের সমস্যা বা অস্বাভাবিক ক্লান্তিকে কখনও হালকাভাবে নেবেন না। সময়মতো চিকিৎসা নিলে প্রাণঘাতী ঝুঁকি এড়ানো সম্পূর্ণ সম্ভব।
